রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে সম্পর্ক আছে কি?

লেখকঃ মো. ওবায়দুল্লাহ*

রাজনৈতিক অস্থিরতা পৃথিবীব্যাপী একটি সাধারণ ঘটনা। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে আমরা এই সমস্যা দেখতে পাই। অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা- উভয়ের মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক ।  রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে এই পারস্পরিক সম্পর্ক সামাজিক, জাতিগত এমনকি জাতীয় পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যত বেশি স্থিতিশীল, তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তত বেশি। ৯৮ টি দেশের প্যানেল ডেটাতে, Barro (1991) রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে সম্পর্ক পরীক্ষা করে। এই গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এই দেশগুলির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর একটি বড় ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে (Barro, 1991)। এছাড়া, Haan এবং Siermann (1996) এর মতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এশিয়া এবং উত্তর আমেরিকায় বিনিয়োগকে ( দেশীয় এবং বৈদেশিক ) বাধাগ্রস্ত করেছে (De Haan & Siermann, 1996)। একইভাবে, Aisen and Veiga (2011) প্রমাণ করেছিলেন, যে উচ্চ মাত্রার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী (Aisen & Veiga, 2011)।

যেহেতু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একে অন্যের সাথে জড়িত, তাই এখানে দুটি জিনিস ঘটতে পারেঃ

প্রথমত, রাজনৈতিক পরিবেশের অনিশ্চয়তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমিয়ে দিতে পারে এবং দেশীয় ও বৈদেশিক- উভয় বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, একটি দুর্বল অর্থনীতির ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে এবং ফলশ্রুতিতে এটি ক্ষমতাসীন সরকারের উৎখাতের কারণ হতে পারে।

রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে তৈরি হতে পারে বিশৃঙ্খলা এবং এর ফলে অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ আসতে পারে। এর কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম- বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সরবরাহ শৃঙ্খলা (সাপ্লাই চেইন) এবং পরিবহণ- ব্যাহত হয় এবং ধ্বস নেমে আসে।

তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে বিশেষত ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে হরতাল বা সাধারণ ধর্মঘট। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, তৈরি পোশাক শিল্প, বাংলাদেশের প্রধান রফতানি শিল্প, প্রতিদিন ৬০০ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হতো হরতালের কারণে। অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের মতে, ২০১৪ সালে, এক দিনের হরতালের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১,৫০০ থেকে ২,০০০ কোটি টাকা । অন্য একটি সমীক্ষা অনুসারে, ১৯৭২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত হরতালগুলোর কারণে দেশের জিডিপির ক্ষতি্র পরিমাণ ৩ থেকে ৪ শতাংশ এর মধ্যে ছিল। এছাড়াও সে সময়ে রফতানি মূল্যের গড় হ্রাস ছিল ০.৪৬৩ শতাংশ (K. Rahman, 2014; M. Rahman, 2014)।

আরেকটি উদাহরণ হতে পারে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, যা ২০১৫ সালে শুরু হয়েছিল এবং এখনও অব্যাহত রয়েছে (BBC News, 2022)। রাজনৈতিক সংকট (Hanon & Wang, 2020) ছিল যার অন্তর্নিহিত কারণ, যেটি পরবর্তীতে যুদ্ধের দিকে ধাবিত করেছিল। এর ফলে খাদ্য ঘাটতি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের  আকাশচুম্বী দাম, খরা এবং মানবিক সংকট দেখা দেয়। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং সরকার-চালিত ও বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত উভয় অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানির ঘাটতির সাথে সাথে সিরিয়ার অর্থনীতি দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।

অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে (Rafi & Wong, 2022)। এই সংকট সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, কোভিড-১৯ মহামারি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ ছাপানো এবং রাজাপাকসে পরিবারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও ব্যাপক দুর্নীতিসহ বেশ কয়েকটি প্রভাবের ফলাফল। অর্থনীতির ভয়াবহ অবস্থার কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ জনগণ একজোট হয়ে আন্দোলন শুরু করে এবং দাঙ্গা সৃষ্টি হয়। ২০২২ সালের মে মাসে দাঙ্গার মধ্যে মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সেই সাথে কিছুদিন পরে রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসেকে ও পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।

একইভাবে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপট আরো জটিল। ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানে ২৯ জন প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন, কিন্তু তাদের কেউই পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি (WION, 2022)। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকেও অর্থনৈতিক সংকট ও গণবিক্ষোভের মধ্যে জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এক রুপির বিপরীতে ডলারের দাম এখন ২৬৬ ডলার। এদিকে, পাকিস্তান দেউলিয়া হয়ে গেছে বলে কিছুদিন আগে মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ (Dawn, 2023)। যার ফলে এটা বলাই যায় যে দেশের আর্থিক মন্দা সরাসরি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার উপর প্রভাব ফেলে।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, রাজনৈতিক উত্থান-পতন দ্বারা একটি জাতির অর্থনৈতিক বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিরতা সাময়িকভাবে বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস করে এবং সেই সাথে বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করতে পারে, যা অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাধা দেয়। এছাড়াও ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগে অনাগ্রহী হবে এবং ভোক্তারা অর্থ ব্যয় করতে কম আগ্রহী হতে পারে, যার ফলে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ হ্রাস পাবে। উপরন্তু, কর সংগ্রহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং জনসাধারণের ব্যয় হ্রাস পাবে। ফলে সরকার আর্থিক ভাবে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অন্যদিকে এই কথাও সত্য যে, অর্থনৈতিক বিশৃংখলার কারণেও দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে।

*মো. ওবায়দুল্লাহ, গবেষণা সহকারী, সেন্টার ফর এডভান্সড সোশ্যাল রিসার্চ , ঢাকা

ই-মেইল: buobaidullah@gmail.com


Discover more from উন্নয়ন অনুধ্যান

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a comment