Modernization theory (আধুনিকায়ন তত্ত্ব)

লেখকঃ- মোঃ রাকিব হোসাইন

উনিশ’শ পঞ্চাশের দশকে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক দেশগুলো অনুন্নত দেশগুলোকে ‘উন্নয়ন-এর যে প্রক্রিয়া বাতলে দিয়েছিল তা ‘আধুনিকায়ন’ নামে পরিচিত। এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, যখন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান “অনুন্নত দেশগুলোকে উন্নত এবং প্রগতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে বৈজ্ঞানিক এবং শিল্প অগ্রগতিকে কাজে লাগানোর জন্য একটি নতুন ও শক্তিশালী কার্যক্রম” গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য হচ্ছে- পিছিয়ে পড়া দেশগুলো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে এবং আধুনিক মন-মানসিকতা চর্চা ও বিকাশের মাধ্যমে উন্নত হতে পারবে। তাদের মতে, একটি দেশের উন্নয়নের পথে যে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চর্চা বাঁধা হয়ে দাড়ায় তা দূর করা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। সুতরাং, দরিদ্র দেশগুলোকে প্রচুর পরিমাণে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়া হবে যেন তারা পশ্চিমা রাষ্ট্রের তৈরি আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারে এবং দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন (যেমন রাস্তা-ঘাট তৈরি) করতে পারে যার মাধ্যমে দেশগুলোর অর্থনৈতিক বাধা দূর হবে এবং দেশি-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে (অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, ঐ সময়ে সমাজতন্ত্রের প্রচার রোধ করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করার জন্য উৎসাহী হয় যেন তারা সমাজতন্ত্র গ্রহণ করার বদলে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রতি অনুগত থাকে)। আর অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে সাথে সাংস্কৃতিক বাধা দূর করতে হবে কিংবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে দূর হয়ে যাবে। যেমন- যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার গঠন, অধিক সন্তান এর পরিবর্তে কম সন্তান গ্রহণ করা (যা থমাস ম্যলথাস, জন স্টুয়ার্ড মিল এর পরামর্শ ছিলো) এবং ‘সেকেলে ধর্মীয় বিশ্বাস’ ত্যাগ করে পার্থিব সম্পদ আহরণে আগ্রহী হওয়া।

আধুনিকায়ন তত্ত্বের প্রবক্তাদের মধ্যে রস্টো (W. Rostow) এর তত্ত্ব উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, দক্ষিণের দরিদ্র দেশগুলো উন্নয়নের পাঁচটি স্তর অতিক্রম করার মাধ্যমে ‘উন্নত’ বা ‘আধুনিক’ হতে পারবে।

একটি দেশের উন্নত হওয়াকে তিনি একটি প্লেনের আকাশে উড্ডয়নের সাথে তুলনা করেন। প্লেন যেভাবে কয়েক স্তর পেরিয়ে মাটি থেকে আকাশে ওড়ে, সেভাবে একটি দেশ আস্তে আস্তে উন্নত হয়। উন্নয়নের পাঁচটি স্তর যথাক্রমেঃ ১. ঐতিহ্যগত বা প্রাচীন সমাজ ২. উড্ডয়নের জন্য ভূমিত্যাগ করার পূর্বশর্ত অর্জন ৩. উড্ডয়নের জন্য ভূমিত্যাগ করা ৪. পরিপক্কতা অর্জন ৫. উচ্চ ভোগের যুগ (Traditional society, Pre-conditions for take-off, Take-off, Drive to maturity, Age of high mass consumption )। প্রথম স্তরটি হচ্ছে প্রাচীন সমাজ (traditional society) যা একটি কৃষিভিত্তিক সমাজ এবং সেকেলে ধ্যান-ধারণা দ্বারা প্রভাবিত। আর শেষ স্তরটি হচ্ছে Age of high mass consumption বা সর্বোচ্চ ভোগের স্তর। এই শেষের স্তরে একটি দেশে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মত একটি স্থিতিশীল ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সবার জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। তার মতে, একটি প্রাচীন সমাজ উন্নত দেশগুলোর মতো আধুনিক প্রযুক্তি ও ধ্যানধারণার অনুসরণ করে অধিক পরিমানে সঞ্চয়-বিনিয়োগের মাধ্যমে ধীরে ধীরে উন্নয়নের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাতে পারবে। এক স্তর থেকে আরেক স্তরে একটি দেশ পৌছুতে পারবে অনেক পুঁজি সঞ্চয়ের ও সেই পুঁজি শিল্প খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে। প্রতি স্তরেই সঞ্চয় ও বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি করতে হবে। ঠিক কতটুকু সঞ্চয়-বিনিয়োগ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন তা একেক দেশে একেক পরিমানে তবে উন্নয়নের জন্য কমপক্ষে জিডিপির ১০ ভাগ বিনিয়োগে ব্যয় করতে হবে বলে অনেকের মত।

`আধুনিকায়ন প্রপঞ্চটি অনেকের মতে একটি পশ্চিমা সাংস্কৃতিক পক্ষপাতদুষ্ট ধারণা যাকে Eurocentric বা নৃতত্ত্বের ভাষায় Ethnocentric ও বলা যায়। একটি দেশকে উন্নত হতে হলে তার প্রাচীন সাংস্কৃতিক প্রথা ত্যাগ করে পশ্চিমা দেশগুলোকেঅনুসরণ করতে হবে; যা একটি ভুল ধারণা। এর বাস্তবিক প্রমাণ হিসেবে Asian Tigers ভুক্ত দেশগুলোর (হংকং, তাইওয়ান, চায়না, কোরিয়া ইত্যাদি) নাম উল্লেখ্যযোগ্য। যেই দেশগুলো তাদের প্রাচীন সাংস্কৃতিক চর্চা পরিত্যাগ করা ছাড়া বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে উল্লেখযোগ্য হারে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছিল। এই দেশগুলো প্রায় হাজার বছর ধরে কনফুসিয়াসের ভাবাদর্শ লালন করে আসছে যা একে-অপরকে সাহায্য করার ওপর অনেক জোর তাগিদ দিয়ে থাকে। কারণ, পরস্পরের সাহায্য-সহযোগিতার ফলে পার্থিব প্রশান্তি অর্জন করা সম্ভব। ফলে দেখা যায়, তারা তাদের কনফুসিয়াস-আদর্শ পরিত্যাগ তো করেনি বরং তা অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে সাহায্য করেছিল।

(মোঃ রাকিব হোসাইন, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।)


Discover more from উন্নয়ন অনুধ্যান

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a comment